রবিবার, ৬ জুন, ২০১০

সমাধান

কি বলব মশাই! আরশোলার উপদ্রবে পাগল হতে বসেছিলাম। বাড়ীটা চারতলায় তাই কুকুর বেড়ালের ত প্রশ্নই ওঠেনা, এমনকি একটা ইঁদুর, ছুঁচো, টিকটিকি কিছুই দেখতে পাইনা। কেবল মাঝে-মাঝে, খুদে-খুদে পিঁপড়ে আর রাশি রাশি শুধু আরশোলা। পরিষ্কার পরিচ্ছন্নর দিকে যে নজর নাই তা নয়। বাড়ির ঝি টা ত ঝাড়া-পোঁছা করেই, আমিও রীতিমত লেগে থাকি। শহরের বেশির ভাগ সব বাড়ীই খুব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, তায় আবার আমার কর্ত্তা এসব ব্যাপারে একটু বেশি মাত্রায় সজাগ।

এবার একটু বিস্তারে বলি। মাইক্রোওয়েভের দরজা খুললাম – এপাশ ওপাশ দিয়ে দুচারটে আরশোলা ঝটিতি দেখা দিয়ে কোথায় যে অদৃশ্য হয়ে গেল, কিছুতেই হদিশ পেলাম না। খাবার গরম করা তখন মাথায় উঠল। সঙ্গে-সঙ্গে ভিনিগারে কাপড় ডুবিয়ে আপাদমস্তক (মাইক্রোওয়েভের)পোঁছা হয়ে গেল। মন খারাপ করে খেতে বসা হল। মন খারাপ এইজন্য কেননা মাঝে একবার মাইক্রোওয়েভটা বিগড়ে গেছিল। মেকানিক ডাকায় বোঝা গেল যে ওটার সার্কিটে নাকি আরশোলার একটা ছোট্ট বাচ্চা কোনোরকমে ঢুকে গেছে। নতুন সার্কিট লাগাতে বেশ কিছু টাকা আক্কেলসেলামি দিতে হল। আর এ ত হল একটা সামান্য ঘটনা। প্রতি পদক্ষেপেই আরশোলাদের সাথে দিনের পর দিন যুঝতে হচ্ছিল। জীবন যেন বিভীষিকাময় হয়ে উঠেছিল। যদিও পুরো বাড়ির আনাচে-কানাচে ওদের একছত্র আধিপত্য গড়ে উঠেছিল, কিন্তু রান্নাঘরটাই ছিল ওদের আসল ঘাঁটি। তাকের পাল্লাগুলো খুললেই ষড়যন্ত্রকারী আরশোলা সমষ্টিকে দেখা যেত আলচনামগ্ন – কি ভাবে বাড়ীর সদস্যগণকে আর ও জব্দ করা যায়।

আরশোলাদের দৌরাত্ম্য কম হচ্ছে না দেখে বেশ কয়েকবার বেগন স্প্রে আনা হল। নিয়ম করে, রাতে শুতে যাবার আগে নালীর জালিগুলোয় ভাল করে স্প্রে করা হল। ও হরি! একদিন-দুদিন যদি বা একটু কমল, আবার যে কে সেই। বান্ধবীদের সঙ্গে এই নিয়ে কথা বলায় একজন বলল – ময়দা আর বরিক পাউডার সমান-সমান মিলিয়ে চিনি ও দুধ দিয়ে ছোট-ছোট গুলি পাকিয়ে রাত্রিবেলায় রান্নাঘরের আনাচে-কানাচে দিয়ে রাখতে। কিন্তু কোথায় আরশোলা! গুলিগুলো সারাদিন পা লেগে-লেগে এদিক-ওদিক গড়াগড়ি খেতে লাগল। তারপর একদিন একটা নামকরা ম্যাগাজিনে পড়লাম – দুধের সঙ্গে চিনি আর বরিক পাউডার গুলে রাত্রি বেলায় প্লেটে রেখে দিতে – ঠিক যেন বেড়াল কে দুধ খেতে দেওয়া। ম্যাগাজিনটার প্রতি যথেষ্ট আস্থা ছিল, সেইজন্য খুব ভরসা নিয়ে, নিশ্চিন্ত মনে সেদিন ঘুমতে গেলাম এই ভেবে যে সকাল হলেই বাজিমাত। রাত্রে ঘুম ত হল, কিন্তু স্বপ্নে শুধু পেল্লাই সাইজ়ের এলিয়ন আরশোলাদের ই দেখলাম – পুরো পৃথিবী কোনো এক অদ্ভুত উপায় দখল করে নিয়েছে। সকাল হলে, রান্নাঘরে গিয়ে দেখি – কোথায় আরশোলা! সমস্ত দুধটা, সারারাত জমে দই হয়ে গেছে আর খুদে-খুদে পিঁপড়েরা চারিদিক ছেঁকে ধরেছে। খুবই মনমরা হয়ে শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিলাম – একমাত্র ঝাঁটার বাড়ি মেরেই ওদের গুষ্টিকে শেষ করতে হবে। দিনের বেলায় ওরা বেশি বের হয় না। তাই মাঝরাতে চুপি-চুপি ঝাঁটা নিয়ে রান্নাঘরে গেলাম। এক হাতে ঝাঁটা, অন্য হাতে টর্চ। আলো জালালাম না পাছে পালিয়ে যায়। চারিদিকে নানান সাইজ়ের আরশোলার আনাগোনা দেখতে পেলাম। এলোপাথাড়ি ঝাঁটার বারি মারতে শুরু করলাম। বেশ কিছু খুদে আরশোলা মারাও পড়ল, কিন্তু ওদের দিদু-দাদুরা দেখলাম আমাকে দিব্যি কলা দেখিয়ে ফড়ফড়িয়ে উড়তে লাগল। আরশোলাদের সচরাচর এভাবে উড়তে দেখা যায় না। বড়-বড় আরশোলাগুলো কে ওভাবে উড়তে দেখে সত্যজিৎ রায়ের ‘ইয়ে’ গল্পটা মনে পড়ে গেল যাতে কুকুরছানাটা আত্মরক্ষার্থে পাখি হয়ে উড়ে চলে গেছিল।

এইভাবে মাঝরাতে উঠে-উঠে আরশোলা মারার উৎসাহ টা কিছু দিনেই দমে গেল, যার ফলে ওরাও মহা আনন্দে বংশ বৃদ্ধি করতে লাগল। এরপরের কথায় আসি। কিছুদিন থেকেই আমার মনে হচ্ছিল, আরশোলাদের সংখায় একটু ঘাটতি হয়েছে। পর-পর কয়দিন খেয়াল করতেই দেখলাম – সত্যিই ত! বড় আরশোলা বলতে গেলে আর দেখাই যাচ্ছে না। কেবল মাত্র ছোট-ছোট আরশোলাগুলোই নজরে পড়ছে। কিছুগুলো সবেমাত্র ডিম ফুটে বেরিয়েছে বা তার চেয়ে আরেকটু বড়। আমার মাথাটা কি ভাবে গুলিয়ে গেল। অনেক মাথা ঘামিয়েও কিছুতেই এই রহস্যের কুল-কিনারা করতে পারছিলাম না। রান্নাঘরের পাল্লাগুলো খুলে সব কোনায় খুঁজে-খুঁজে দেখলাম। না! বড় আরশোলার কোথাও নামগন্ধ ও নেই। এ ত বড় আশ্চর্য্যের ব্যাপার। কারো সাথে এই নিয়ে কথা বলতেও সাহস হচ্ছিল না কারণ এমনিতেই আমার আরশোলা ফোবিয়া নিয়ে সবাই ঠাট্টা করতে শুরু করেছিল। এর পরে ত আমায় কেবল পাগল ঠাওরাবে। আরশোলা সমস্যাটা ধীরে-ধীরে সমাধান হয়ে যাচ্ছে ভেবে কোথায় আনন্দ করব তা না আমার মাথায় রহস্যের চিন্তা টা পোকার মত কুরে-কুরে খেতে লাগল। রাতে ভাল ঘুম হত না। খাওয়ায় রুচি নাই। নিজে কে নিয়ে কি করব নিজেই বুঝতে পারছিলাম না।

হঠাৎ একদিন রাত্রিবেলায় জল খেতে রান্নাঘরে গিয়ে দেখি – কি একটা ধীরে-ধীরে, ছায়ার মত মিলিয়ে গেল। ঘুম চোখে কিছুই বুঝতে পারলাম না। এসে শুয়ে পড়লাম। এরকমই আবার কিছুদিন পর মধ্য রাতে, রান্নাঘরে গিয়ে দেখলাম, কি একটা যেন চোরের মত, চুপিসাড়ে, অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। সেদিন বলতে গেলে একটু ঘাবড়েই গেছিলাম। আগেই বলেছি, আমাদের বাড়ি কুকুর, বেড়াল, ইঁদুর কিছুই নাই। তাহলে কে এ’রম মধ্যরাতে আসে আর আমাকে দেখেই অন্ধকারে মিলিয়ে যায়। এর সাথে কি সেই আরশোলা রহস্যের কোনো যোগাযোগ আছে? এর একটা কিনারা করতেই হবে। পরদিন রাতে আর না ঘুমিয়ে, আমি ঠিক মধ্যরাতে উঠলাম এবং রান্নাঘরে গিয়ে ছোট, আবছা আলোটা না জ্বালিয়ে জোরালো আলোটা জ্বালিয়ে দিলাম। আর জ্বালাবার সঙ্গে-সঙ্গে দেখলাম কুড়াদানের নিচে থেকে বেশ বড়-সড় একটা টিকটিকি ছুটে পালিয়ে পাল্লার নিচে ঢুকে গেল। তখন সবকিছুই জলের মত পরিষ্কার হয়ে গেল। প্রকৃতিই সব কিছু ব্যালেন্স করে রেখেছে। আমাদের বেশি মাথা না ঘামালেও চলবে।

কোন মন্তব্য নেই: