বন্ধুগণ সকলকে জানাই নববর্ষের শুভেচ্ছা ও ভালবাসা। বহুদিন পরে ব্লগে বসলাম, কেননা গরমের ছুটি শুরু হয়ে গেছে। প্রতিদিনের কাজের ফাঁকে –ফাঁকে কিছু গল্প ও কবিতা লেখার চেষ্টা করেছি। সেই সংকলনের থেকে একটা গল্প নিলাম। গল্পের নাম-
এক অবিস্মরণীয় রাতজুন মাসের এক সামার ক্যাম্পে, কুড়িজন স্কুলের ছাত্রীকে নিয়ে আমরা দুজন শিক্ষিকা মধ্যপ্রদেশের 'পঞ্চমড়ী' নামে এক হিল স্টেশনে গিয়েছিলাম। ক্যাম্পে তিনশজন সদস্যদের মধ্যে সবার ছোট দশ বছরের পারুল। প্রতিদিন প্রায় বারো কিলমিটার করে হেঁটে দুদিনেই সকলের পা লোহার মত ভারী হয়ে দাঁড়াল। কেবল মনে হত কতক্ষণে সন্ধ্যে হবে আর ক্যাম্প-ফায়ার এ্যাটেন্ড করে বিছানায় গা এলিয়ে দেব
।
ট্রেকিং এর সময় একদিন ক্যাম্পে ফিরতে সন্ধ্যে হয়ে গেল। এরপর ক্যাম্প-ফায়ার – মানে নাচ-গানের পালা। তারপর শয্যাগ্রহণ। হঠাৎ শুনলাম সকলকে তৈরী হয়ে নিতে হবে নাইট ট্রেকিং এর জন্য। ক্যাম্পের পরিচালক জানিয়ে দিল যে পোকামাকড়ের হাত থেকে বাঁচতে যতটা সম্ভব শরীর ঢেকে রাখতে হবে, কেবল মুখের কিছুটা অংশ খোলা থাকবে।
আমাদের তিনশ জনকে একটা লম্বা লাইনে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হল। ছোট বাচ্চাদের মত হাতদুটো আগের জনের কাধেঁ রেখে চলতে হবে। একটাও কথা বলা চলবে না। নিজের সাথে টর্চ রাখা চলবে না। আমরা এখন পশু-পাখীর রাজত্বে প্রবেশ করতে যাচ্ছি। আমাদের কোনো অধিকার নেই ওদের জীবনযাত্রায় ব্যাঘাত ঘটাবার। যদি একান্তই প্রয়োজন হয় তাহলে আস্তে করে বলতে হবে ‘হল্ট’। দলের আগে দুজন পরিচালক রইল এবং সবশেষে দুজন। চারজনের কাছেই প্রয়োজন মত অস্ত্র-শস্ত্র ছিল।
এবার শুরু হল আমাদের ‘নাইট ট্রেকিং’। আমরা ছোট বড় তিনশ জন, অন্ধকার রাতে, রীতিমত অন্ধের মত পা টিপে-টিপে নিঃশব্দে এগোতে লাগলাম। এবড়ো খাবড়ো রাস্তায় হাঁটতে খুবই অসুবিধা হচ্ছিল। পা ফেলে-ফেলে বুঝে নিতে হচ্ছিল আগে কোনো খানা-খন্দ আছে কি না। মাঝে মধ্যেই জন্তু জানোয়ারের নানা রকম আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল। সত্যি বলতে গেলে কি একটু-একটু ভয়ও করছিল। বেশ কিছুটা এগিয়েছি, হঠাৎ দেখলাম এদিক-ওদিক আলোর ঝিলিক। আলোগুলো একবার করে জ্বলছে আর নিভছে। চারিদিক ঘন অন্ধকারের মাঝে-মাঝে আলোর জ্যোৎস্না যে কি রকম সুন্দর লাগছিল তা বলে বোঝানো যায় না। একটু খেয়াল করতেই বুঝতে পারলাম আসলে ওগুলো জোনাকী পোকা। এক একটা গাছে পুরোপুরি ছেয়ে রয়েছে। গাছগুলোর যে রকম আকার, আলোর ঝিলিকও সেইভাবেই দেখা দিচ্ছে। এইরকম মায়াবী আলো আধাঁরের মাঝখান দিয়ে আমাদের দল মন্থর গতিতে এগোতে লাগল। কোথায় যাচ্ছি, কতদূর আর যেতে হবে, কিছুই জানা নেই। কিছু জিজ্ঞেস করারও উপায় নেই। ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত, রোমাঞ্চিত আমরা যেন এক অদ্ভুত মোহমায়ার টানে এগিয়ে চলেছি। হঠাৎ অনুভব করলাম – কই, জন্তু-জানোয়ারের ডাক ত আর শুনতে পাচ্ছি না। চারি দিকে নিশ্ছিদ্র অন্ধকার অথচ পা ফেলতে আর একটুও অসুবিধা হচ্ছে না! যেন শ্বেত পাথর দিয়ে বাঁধানো মসৃণ জমি। এ কোন জগতে প্রবেশ করলাম? এ কি কোনো মায়াপুরী না এলিয়ন জগত? এক অদৃশ্য টানে পা নিজে থেকেই এগিয়ে চলেছে। এই রোমাঞ্চকর শিহরণের মাঝেই লম্বা লাইনটা হঠাৎ গোল হতে শুরু করল। এখন আর আমাদের হাত দুটো অন্যজনের কাঁধে নেই বরঞ্চ একে অপরের হাত ধরে রয়েছি এবং গোলাকার এক বৃত্ত রচনা করে সকলেই বসে পড়েছি। কিন্তু এই অদৃশ্য সঞ্চালন কোথা থেকে হচ্ছে? কাউকেই ত দেখতে পাচ্ছি না। সেই চারজন অস্ত্রধারীই বা গেল কোথায়? আমরা নির্বাক হয়ে তিনশ জন বসে রইলাম। আকাশে চাঁদ তারা কিছুই দেখা যাচ্ছে না। নাকি ওটা আকাশই নয়! এলিয়ন জগতে কি চাঁদ তারা বলে কিছু নেই?
এইসব আকাশ পাতাল ভাবতে-ভাবতে হঠাৎ এ কি দেখলাম? আমাদের গোলাকার দলে, সকলে ত বেশ স্থির হয়েই বসেছিল। যদিও কায়ার চেয়ে তাদের ছায়া রূপটাই বেশি দেখতে পাচ্ছিলাম। কিন্তু আমার ঠিক সামনের জন কোথায় চলে গেল? দুজনের মাঝে একটা গ্যাপ কি ভাবে সৃষ্টি হয়ে গেল? কাউকেই ত উঠে যেতে দেখলাম না। তাহলে কি আমার সংশয়টা নিশ্চিতে পরিণত হতে চলেছে? মাথাটা কিরকম ঝিম-ঝিম করতে শুরু করেছে। এ কি! চারটে মাথা বাদ দিয়ে আবার একটা মাথা নেই দেখছি। তাহলে কি প্রতি পঞ্চমজন কে ওরা অদৃশ্য শক্তিতে নিজেদের কাছে টেনে নিচ্ছে? দেখতে-দেখতে আবার পঞ্ছমজনের জায়গা শুন্য মনে হল। আচ্ছা! এক-এক করে কি ভাবে ওরা বিলীন হয়ে যাচ্ছে? প্রফেসর শঙ্কুর ‘এ্যানাইহিলিন’ গান ত শুনেছি। (যা দিয়ে যে কাউকে নিশ্চিহ্ন করা যায়) কিন্তু কাউকে ত সেরকম কিছু চালাতে দেখলাম না! ততক্ষণে আমি রীতিমত ঘামতে শুরু করেছি। তাড়াতাড়ি গুণে দেখবার চেষ্টা করলাম যে আমি হতভাগ্য পঞ্ছমের মধ্যে পড়ছি কি না। উন্মাদের মত যখন গুনছি তখন দেখলাম, না – আর কোনো নিয়ম মেনে নয়, মাঝে মধ্যেই এক-একটা স্থান শুন্য হয়ে যাচ্ছে। সারাদিনের ক্লান্ত শরীরে আর কিছুই ভাবতে পারলাম না। যাদের হাতে আমরা পড়েছি তাদের কি উদ্দেশ্য? এই পার্থিব শরীরগুলো নিয়ে ওরা কি কিছু টেস্ট করতে চায়? হঠাৎ মনে হল বহুদূরে এক আলোক বিন্দু দেখতে পেলাম। এবার তাহলে ওদের স্পেসশিপ টা এসেছে আমাদের সুদূরপারে নিয়ে যাওয়ার জন্য। ভাগ্যের হাতে নিজেদের ছেড়ে দেওয়া ছাড়া আর কিছুই করার নেই। নীরবতা ভঙ্গ করা চলবে না তাতে প্রাণ যায় যাক। আলোক বিন্দুটা যত এগিয়ে আসতে লাগল, দেখলাম, স্পেসশিপ যেমন গোল হয় শুনেছিলাম তেমন ত নয়, বরঞ্চ কিরকম জীপের আকারের। একেবারে কাছে এলে পর দেখলাম – না, কোনো স্পেসশিপ নয়, জীপ ই। হঠাৎ কোথা থেকে সেই চারজন পরিচালকও চলে এল। ডান দিকে ফিরতেই দেখি, পাশের জনের মাথাটিও উধাও। কখন যে পারুল আমার কোলে মাথা দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে, বুঝতেও পারিনি। পরিচালকগণ সব ঘুমন্ত (উধাও) বাচ্চাদের তুলে গরম বোর্নভিটা খেতে দিল। আমরা সকলে বোর্নভিটা খেয়ে চাঙ্গা হয়ে নিলাম। আবার সেই রকমই কাঁধে হাত রেখে, নীরবে, লাইন করে ক্যাম্পে ফেরা হল
।
পরে জেনেছিলাম মসৃণ জায়গাটা ছিল একটা হেলিপ্যাড। ‘নাইট-ট্রেকিং’ এর জন্য সব আলোগুলো বন্ধ রাখা হয়েছিল।