ছেলেটির নাম বিক্রম। বয়স সাত। তিন দিদির আদরের ছোট ভাই। ওরা যে স্কুলে পড়ে, আমি সেই স্কুলেরই শিক্ষিকা। দিদিরা প্রতিদিন নিয়ম করে টিফিনে ভাইয়ের কাছে এসে তার খাওয়ার দেখাশোনা করে তারপর যেত। আমি অনেকবার বুঝিয়েছি যে বিক্রমকে নিজেই খাবার খেতে দাও। ওকে একা ছেড়ে দিলে ও বেশি সাব্যস্ত হবে, কিন্তু প্রাণপ্রিয় ভাইকে বেশীক্ষণ একা ছেড়ে তারা থাকতেই পারত না।
ওদের বাবা হাবিলদার। আর্থিক অবস্থা খুব সুবিধের নয়। কিন্তু ওরই মধ্যে চারজনাই বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে স্কুলে আসত। বিক্রমের তিন দিদিই একসময় আমার ছাত্রী ছিল। তিনজনাই বেশ মেধাবী, কিন্তু ছোট ভাইটা বেশী আদরের জন্যই হউক বা যে কোন কারণেই হউক, পড়াশুনোয় বেশ একটু কাঁচা ছিল। মনে হত পড়াশুনো যেন ওর মাথাতে ঢুকছেই না। পড়াশুনোয় ভাল না হলেও, এত শান্ত-শিষ্ট নিরীহ গোছের ছিল যে কি বলব! চেহারাটা ছিল একেবারে মায়া মাখানো, মন কাড়ানো। ক্লাসে অন্যান্য বাচ্চারা চেঁচামেচি, ঝগড়া-ঝাঁটি করত কিন্তু বিক্রম সব সময়ই চুপ করে বসে থাকত। মাঝে-মাঝে ভাবতাম ওর নামটা ওর আচার-আচরণের সাথে একেবারেই খাপ খায় না।
প্রতি তিন মাস অন্তর যখন পেরেন্ট টীচার মীটিং হত, বিক্রমের বাবা কখনই আসতে পারত না – কেননা বেশিরভাগ সময়ই বাইরে-বাইরে নন-ফ্যামিলি স্টেশনে পোস্টিং এ থাকতে হত। বিক্রমের মা অবশ্য আসত। নিরীহ গোবেচারা চেহারার মানুষ। তিন-চার ক্লাস অবধি পড়েছে। পড়াশুনার ব্যাপারে কথা বললে কিছুই বুঝতে পারেনা। অগত্যা দিদিদেরই বুঝিয়ে বলতাম, বিক্রমের পড়াশুনোর দিকে একটু খেয়াল রাখতে।
বিক্রম যে কেবল পড়াশোনাতেই পিছিয়ে থাকত তা নয়। খেলাধুলোতেও তার কোনো আগ্রহ ছিল না। গেম্সের পিরিয়ডে অন্য বাচ্চারা খেলাধুলো করত, ও কিরকম ছল-ছল চোখে চুপ করে বসে থাকত। এক-আধবার আমি ওর মাকে বলেছি যে বিক্রমকে একজন ভাল ডাক্তারকে দেখাও কারণ ওর কাশি ও গলা ব্যথা লেগেই থাকত। ওর মা একা হাতে চারটে বাচ্চা নিয়ে, সংসার করে আর পেরে উঠত না। অভাবের সংসারে মার চেহারাও সেরকম। সব সময়ই যেন ধুঁকছে। আমাদের স্কুলে বেশীরভাগ বাচ্চারা এইসব পরিবার থেকেই আসে, তাই আমরা খানিকটা অভ্যস্ত হয়ে গেছি। তারই মাঝে যতটা সম্ভব ওদের সুস্বাস্থের মর্ম বোঝাই।
বাচ্চাদের পড়ানো ছাড়াও আমাদের নানারকম অন্য কাজও করতে হয়। তার মধ্যে একটা হল রিলিফ ফান্ড জোগাড় করা। কখনও বণ্যাত্রাণ, কখনও ওল্ড-এজ রিলিফ, আবার কখনও ক্যান্সার সাহায্য। সব বাচ্চাদের ফর্ম দিয়ে দেওয়া হয়। বাচ্চারা বাড়ী-বাড়ী গিয়ে নিজের প্রতিবেশীদের থেকে বা নিজের আত্মীয়-স্বজনদের থেকে দশ টাকা, বিশ টাকা, যে যেমন দেয় – জোগাড় করে। যে যত টাকা জোগাড় করে, সে হিসেবে তাদের সার্টিফিকেট, ব্যাজ, রিলিফ ফান্ড নামের টি-সার্ট এসব দেওয়া হয়। পুরো স্কুলের যে ছাত্র সব থেকে বেশী টাকা জোগাড় করে, তাকে একটা স্পেশাল শীল্ড দেওয়া হয়।
সেবার ফর্ম এল ক্যান্সার রিলিফের। আমি সব বাচ্চাদেরই ফর্ম দিয়ে দিলাম। বলতে ভুলে গেছি, আমি বিক্রমের ক্লাস টীচার ছিলাম। বাচ্চাদের মোটিভেট করতাম যাতে তারা বেশী-বেশী টাকা জোগাড় করতে পারে কারণ টাকাটা একটা ভাল সংস্থানে যাবে আর পুরস্কার স্বরূপ ওরাও অনেক জিনিষ পাবে যেমন টি-সার্ট, ব্যাজ, সার্টিফিকেট, শীল্ড এসব। আমার মোটিভেশানের জন্যই হউক বা যে কারণেই হউক বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আমার ক্লাসের বাচ্চাদের কালেকশন সবথেকে বেশী হত। কএকবার ত শীল্ডটাও আমারই ক্লাসের বাচ্চা পেত। এইবার ক্লাস কালেকশনটা বেশী হয়নি। হয়ত বাচ্চারা খুব ছোট বলে। কিন্তু আশ্চর্য্যভাবে বিক্রম একাই পনেরোশো টাকা জোগাড় করে আনল। বিক্রমকে জিগেস করায় ও কিছুই বুঝিয়ে বলতে পারল না। বুঝলাম তিন দিদি মিলে ভাইকে খুশী করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করেছে। আমাদের স্কুল টা সরকারি স্কুল। একটা বাচ্চার পনেরোশো টাকার জোগাড় করা মানে অনেক বড় ব্যাপার। স্কুলের রেকর্ডে খোঁজ নিয়ে দেখলাম ক্লাস ‘টু’ – সেক্শান ‘এ’, বিক্রমের কালেকশানই সবথেকে বেশী – অর্থাৎ শীল্ডটা ওই পাবে। অর্গানাইজেশন টীমের সমক্ষে, প্রিন্সিপালের হাত থেকে, সব বাচ্চাদের সামনে, স্টেজে উঠে, শীল্ডটা নেওয়া অনেক সম্মানের ব্যাপার। এই ভেবে ভাল লাগল যে, যাক্ কোনো বিষয়ে ত ও এগিয়ে আছে! বাচ্চাটা যেন হাসতেও ভুলে গেছিল।
এরপর দুমাসের জন্য গরমের ছুটি পড়ে গেল। পয়লা জুলাই স্কুল খুলতেই আমাদের প্রথম কাজ হয় বাচ্চাদের ফীস নেওয়া। দশ জুলাই ফীস দেওয়ার অন্তিম দিন। ক্লাসের সব বাচ্চার ফীস এসে গেল অথচ বিক্রমের ফীস এখনও এলনা। স্কুল খোলার পর থেকে বিক্রম একদিন ও আসে নি। দশ তারিখের পর ফীস দিলে প্রতিদিন পাঁচ টাকা করে ফাইন দিতে হয়। ফীসের ব্যাপারে পেরেন্টসদের রিমাইন্ডার দেওয়া যদিও টীচারের ডিউটির মধ্যে পড়ে না তবুও আমি প্রিন্সিপালের রুমে গেলাম ফোন করার জন্য। ফোন করতেই ওপার থেকে পুরুষের কণ্ঠস্বর ভেসে এল। মনে হয় বিক্রমের বাবা। ফীস না দেওয়ার কারণ জিগেস করায় বলল – কিসের ফীস? আমি একটু অবাক হয়ে গেলাম কেননা ওর বাবার সাথে কোনোদিন কথা বলার সুযোগ হয়ে ওঠে নি। আমি একটু রাগত ভাবে যখন বুঝিয়ে বললাম যে আজ ফীস জমা দেওয়ার অন্তিম দিন আর বিক্রমের ফীস এখনও জমা পড়ে নি তখন ভদ্রলোক খানিকক্ষণের জন্য চুপ করে গেলেন তারপর অতি শান্ত ভাবে বললেন – “ম্যাডাম, বিক্রম গত সপ্তাহে গলার ক্যান্সারে মারা গেছে।” শুনেই আমার মাথাটা কিরকম ঘুরে গেল। আমার ছল-ছল চোখ দেখে প্রিন্সিপাল ঘাবড়ে গিয়ে জিগেস করলেন – “ম্যাডাম, কি হয়েছে?” আমি রিসিভারটা প্রিন্সিপালের হাতে দিয়ে চেয়ারে ধপাস করে বসে পড়লাম।
তারপর ‘সেইদিন’ এল। ক্যান্সার রিলিফ অরগানাইজেশানের টীম প্রিন্সিপালের সাথে স্টেজে উঠল। সামান্য বক্তৃতার পর ঘোষণা করা হল – যে ক্লাস সবথেকে বেশী ফান্ড কালেক্ট করেছে এবং সেই টীচারকে শীল্ড দেওয়া হল। যেটা আমি পূর্বে বেশ কয়েকবার পেয়েছি। এইবার নাম ঘোষণা হবে যে ছাত্র সবথেকে বেশী ফান্ড জোগাড় করেছে। আমি ভীষণ নার্ভাস ফীল করছিলাম। শ্রীমান বিক্রমের নাম ঘোষণা হতেই আমার দম যেন বন্ধ হয়ে এল। নিমেষের জন্য চোখও বন্ধ হয়ে গেল। চোখ খুলতেই দেখি বিক্রমের তিন দিদি স্টেজের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আমি ত ভাবছিলাম ওরা কান্নায় ভাসিয়ে দেবে, কিন্তু দেখলাম ওরা তিনজনেই হাসিমুখে স্টেজে চড়ছে। ছল-ছল চোখ ছাড়া আর কোনো ভাবেই ওদের দুঃখ কষ্ট প্রকাশ পাচ্ছিলনা। ওদের বুকভরা কান্না শুধু আমিই বুঝতে পারছিলাম। প্রিন্সিপাল বিক্রমের বিষয়ে দুকথা বলে শীল্ডটা ওদের হাতে ধরিয়ে দিল। হাততালির যেন বন্যা বয়ে গেল। বিক্রম প্রাণ দিয়ে বীর-বিক্রমে দেখিয়ে দিল ওর দিদিরা (মেয়েরা) নতুন যুগের।
বৃহস্পতিবার, ২৬ আগস্ট, ২০১০
এতে সদস্যতা:
পোস্টগুলি (Atom)